নিজস্ব প্রতিবেদক, কুমিল্লা:অনিক হাসান
বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত মুরাদনগর উপজেলা—একটি ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষের বসবাস এই উপজেলায়, যা মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস, ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য এবং আধুনিক স্থাপনায় গড়ে উঠেছে নতুন রূপে।
⸻
🕊 মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মুরাদনগর
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে মুরাদনগর ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধ এলাকা। উপজেলাজুড়ে ছিল মুক্তিবাহিনীর সক্রিয়তা। চাপিতলা, খামারগাঁও, কাশিমপুর, কৃষ্ণপুর, রামচন্দ্রপুর, ফোগরারচরসহ অনেক গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘটিত হয় তীব্র প্রতিরোধ।
বিভিন্ন গ্রামে গণহত্যা চালানো হয়, বহু নারী নির্যাতিত হন। শত শত মানুষ শহীদ হন, যাদের মধ্যে মনমোহন দেবনাথ, মতিলাল দেবনাথ, শাহজাহান, বিল্লাল হোসেনসহ আরও অনেক নাম ইতিহাসে অম্লান।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও এখনও অনেক শহীদের কবর ও স্মৃতি সংরক্ষণের অপেক্ষায়।
⸻
🕌 আল্লাহু চত্বর: ধর্মীয় ভাবনায় আধুনিক স্থাপত্য
২০১৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বর মুরাদনগর সদরের পূর্বপাশে বাসস্ট্যান্ড এলাকায় নির্মাণ করা হয় “আল্লাহু চত্বর”। ৩০ ফুট উচ্চতার এই স্তম্ভে আল্লাহর গুণবাচক ৯৯টি নাম খোদাই করা হয়েছে অত্যন্ত শিল্পসৌন্দর্যের সঙ্গে।
এটি শুধু একটি ধর্মীয় নিদর্শন নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক ও পর্যটন আকর্ষণ হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছে। মুসলিম ধর্মীয় ঐতিহ্যকে আধুনিক স্থাপত্যে রূপ দেওয়ার একটি দুর্দান্ত উদাহরণ এই চত্বর।
⸻
🏛 জমিদার বাড়ি ও ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা
মুরাদনগরে রয়েছে শতাব্দীপ্রাচীন জমিদার বাড়ি ও স্থাপত্যের নিদর্শন। এর মধ্যে জাহাপুরের জমিদার বাড়ি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যার বয়স প্রায় ৪০০ বছর।
পুরনো রাজকীয় কাঠামো, কারুকার্য খচিত দরজা-জানালা, মেঝের নকশা ও বিশাল উঠান এই বাড়িকে একটি জীবন্ত ইতিহাস হিসেবে উপস্থাপন করে।
সম্প্রতি এই জমিদার বাড়িতে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের শুটিংও সম্পন্ন হয়েছে, যা ভবিষ্যতে স্থানীয় পর্যটন ও চলচ্চিত্রাঙ্গনে অবদান রাখবে।
⸻
🛣 যোগাযোগ ও যাতায়াত ব্যবস্থা
ঢাকা থেকে মুরাদনগর যেতে হলে সায়েদাবাদ, মহাখালী কিংবা কমলাপুর থেকে কুমিল্লা বা কোম্পানীগঞ্জগামী বাসে ময়নামতি (ক্যান্টনমেন্ট) পর্যন্ত গিয়ে, সেখান থেকে স্থানীয় যানবাহনে দেবিদ্বার হয়ে মুরাদনগর পৌঁছানো যায়।
নিজস্ব গাড়িতে একদিনেই ঘুরে আসা যায়। এছাড়া কুমিল্লা শহরে থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা রয়েছে।
তবে মুরাদনগরের অনেক গ্রামীণ রাস্তাঘাট এখনো উন্নয়নাধীন, যা পর্যটন বিকাশে বড় চ্যালেঞ্জ।
⸻
🌾 লোকজ সংস্কৃতি ও জনজীবন
মুরাদনগর এলাকার জনগণ অতিথিপরায়ণ, ধর্মপ্রাণ ও সংস্কৃতিসমৃদ্ধ। পল্লীগীতিতে সমৃদ্ধ এই জনপদে রয়েছে নানা ধরনের মেলা, হাট ও উৎসব। কৃষিভিত্তিক জীবনধারার পাশাপাশি দিন দিন শিল্প ও বাণিজ্যতেও গড়ে উঠছে নতুন সম্ভাবনা।
⸻
উপসংহার
মুরাদনগর শুধুমাত্র একটি উপজেলা নয়, এটি বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও আধুনিক ইসলামিক স্থাপত্যের এক অনন্য প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস, শতবর্ষী জমিদার স্থাপনা এবং নবনির্মিত আল্লাহু চত্বর মিলিয়ে এটি হয়ে উঠছে একটি সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্র।
⸻